স্বদেশ ডেস্ক:
মুমিনের প্রতিটি কাজই ইবাদত। ঘুমও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি কোনো ব্যক্তি ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতিতে ঘুমায়, তার ঘুমও ইবাদতে পরিণত হয়। রাতে ঘুমানোর আগে কিছু করণীয়-বর্জনীয় কাজ রয়েছে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
রাতে দেরি করে না ঘুমানো
রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। (মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৭৯)
তাই রাতের বেলা কোনো অহেতুক কাজ, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, কোনো বিনোদন উপভোগে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত।
একাকী ঘরে না ঘুমানো
কোনো ঘরে একা ঘুমানোর ব্যাপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কোনো ঘরে একাকী রাত যাপন ও একাকী সফর করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৬৫০)
খোলা আকাশের নিচে না ঘুমানো
অনুরূপ ছাদেও ঘুমানো যাবে না। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বেষ্টনীবিহীন ছাদে রাতে ঘুমাল, (কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে) তার সম্পর্কে (আল্লাহর) কোনো জিম্মাদারি নেই।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪১)
রাতে নিরাপদে ঘুমানোর জন্য রাসুল (সা.) কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যেগুলোর ওপর আমল করলে একদিকে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, অন্যদিকে প্রিয় নবীর সুন্নত আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাতে পানাহারের পাত্রগুলো ঢেকে রেখো। ঘরের দরজাগুলো বন্ধ রেখো। আর সাঁঝের বেলা তোমাদের বাচ্চাদের ঘরে আটকে রেখো, কারণ এ সময় জিনেরা ছড়িয়ে পড়ে এবং কোনো কিছুকে দ্রুত পাকড়াও করে। নিদ্রাকালে বাতিগুলো নিভিয়ে দেবে। কেননা অনেক সময় ছোট ক্ষতিকারক ইঁদুর প্রজ্বালিত সলতেযুক্ত বাতি টেনে নিয়ে যায় এবং গৃহবাসীকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩১৬)
খাবারের পাত্র ঢেকে রাখা
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে খাবারের পাত্র না ঢাকলে তাতে ইঁদুর, তেলাপোকা বা অন্য কোনো পোকা এসে হানা দিতে পারে। ফলে তা থেকে ছড়াতে পারে মারাত্মক রোগ।
ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথ বলে একটি অধ্যায় আছে, যাতে খাবারের মধ্যে ইঁদুরের ছড়ানো ভাইরাসে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। রাতের বেলা আমরা ঘুমিয়ে পড়লে ইঁদুরের বিচরণ বেড়ে যায়। খাবারদাবার ভালোভাবে না ঢাকলে তারা আমাদের খাবারে এসে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
ঘরের দরজা বন্ধ রাখা
রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে রাখা আবশ্যক। কারণ রাতে দরজা খোলা রেখে ঘুমালে চোর-ডাকাতের কবলে পড়তে হতে পারে।
নিদ্রাকালে বাতি নিভিয়ে দেওয়া
রাতে ঘুমানোর আগে ঘরের চেরাগ, মোমবাতি, কয়েল ইত্যাদি নিভিয়ে দিতে হবে। কারণ এগুলো থেকে অনেক সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ঘরকে অন্ধকার করে নেওয়া জরুরি। কারণ অন্ধকার শরীর থেকে ঘুমের সময় মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি করে, যা শান্তির ঘুমের সহায়ক। মেলাটোনিন মাথায় পিনেয়াল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হওয়া এক বিশেষ ধরনের হরমোন, যা বুদ্ধি বাড়ায়। মাথার কাজ করার ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। তা ছাড়া এই হরমোনটি ক্যান্সার ও আলঝেইমারস কমাতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের সময়টা ঘর অন্ধকার রাখা খুবই দরকার।
পবিত্রতা অর্জন
রাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয়ে শোয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কোনো মুসলমান রাতে আল্লাহকে স্মরণ করে অজু শেষে শয়ন করে এবং রাতে জাগ্রত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাআলা তা দান করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৪২)
বিছানা ঝেড়ে নেওয়া
নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কেউ শয্যায় যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির দ্বারা বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ সে জানে না যে বিছানার ওপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কি না। তারপর এই দোয়া পড়বে—হে আমার রব! আপনারই নামে আমার শরীরটা বিছানায় রাখলাম এবং আপনারই নামে আবার উঠব।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩২০)
চোখে সুরমা লাগানো
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.)-এর একটি সুরমাদানি ছিল। প্রতি রাতে (ঘুমানোর আগে) তিনি ডান চোখে তিনবার এবং বাঁ চোখে তিনবার সুরমা লাগাতেন। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ৪১)
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুরমা চোখের জন্য ছোঁয়াচে সব ধরনের রোগ-জীবাণু ধ্বংস করে। চোখে প্রবেশকৃত ধুলা ও ক্ষতিকর পদার্থগুলো নিঃসরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধক জীবাণু ধ্বংস করে। চোখে জ্বালাপোড়া নিরাময় করে।
ডান কাতে শোয়া
এর মানে এই নয় যে সারা রাত আর বাঁ দিকে কাত হওয়া যাবে না। তবে ইসলামে সব ভালো কাজে যেহেতু ডানকে প্রাধান্য দিতে বলেছে, তাই আমাদের ঘুমের বেলায়ও ডান দিক থেকে শুরু করতে পারি। এ জন্য ডান কাত হয়ে ঘুমালে আমাদের হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস ইত্যাদির অবস্থান স্বাভাবিক থাকে, যা বাঁ কাত হয়ে ঘুমানোর চেয়ে বেশি উপকারী।
দোয়া পড়া
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শোয়ার পর আল্লাহর নাম নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে লাঞ্ছনা নেমে আসবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৫৬)
হাদিস শরিফে ঘুমানোর আগে কয়েকটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে। সব দোয়া পড়তে না পারলেও ছোট এই দোয়াটি পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া’, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি শয়ন করছি এবং তোমারই দয়ায় আমি পুনর্জাগ্রত হব।’
সুরা ইখলাস ও নাস-ফালাক পড়ে শরীরে ফুঁ দেওয়া
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে যখন বিছানায় যেতেন, তখন দুই হাত একত্র করে তাতে সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। অতঃপর মাথা ও চেহারা থেকে শুরু করে যত দূর সম্ভব দেহে তিনবার দুই হাত বোলাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০১৭)
আয়াতুল কুরসি পড়া
রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যখন শয্যা গ্রহণ করবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়বে। তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩১১)
সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া
কোনো ব্যক্তি ঘুমানোর আগে এ দুই আয়াত পড়লে তা তাদের গোটা রাতের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করে, তবে এটিই তার জন্য যথেষ্ট। (বুখারি, হাদিস : ৫০৪০)
সুরা মুলক পড়া
রাসুল (সা.) বলেছেন, কোরআনের মধ্যে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে, যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক)। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯১) রাসুল (সা.) এই সুরা না পড়ে কখনো ঘুমাতে যেতেন না। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯২)